২. ইয়াহইয়া ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সায়িদ….নাফি‘ ইবনে মাহমূদ ইবনূর রবী‘ থেকে বর্ণিত। নাফি‘ র. বলেন, (একদা) উবাদা (রা:) ফজরের সালাত পড়তে বিলম্ব করলেন। মুআযযিন আবূ নুআইম রহ. নামাযের ইকামত দিলেন। আর আবূ নুআইম-ই সর্বপ্রথম বায়তুল মুকাদ্দাসে আযান দিয়েছেন। অতঃপর আবু নুআইম লোকদের নিয়ে সালাত পড়লেন। উবাদা (রা:) এলেন এবং আমি তার সাথে ছিলাম। শেষে আমরা আবু নুআইম এর পিছনে কাতারে দাঁড়ালাম। আবূ নুআইম (র.) সশব্দে কিরাআত পড়লেন। (ইমামের পিছনে) উবাদা (রা:) সূরা আল-ফাতিহা পড়লেন। সালাত শেষে আমি উবাদা (রা:) কে বললাম, অবশ্যই আপনি এমন একটি কাজ করেছেন, আমি জানি না এটি কি সুন্নাত, নাকি আপনি ভুল করেছেন? তিনি বলেন, তা কি? তিনি বলেন, আমি আপনাকে সূরা আল-ফাতিহা পড়তে শুনেছি, যখন আবু নুআইম রহ. সশব্দে কিরাআত পাঠ করেছেন। তিনি বলেন, হাঁ। রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাদের কোন এক ওয়াক্তে সালাত পড়ান, যাতে তিনি সশব্দে কিরাআত পাঠ করেন। তার জন্য কিরাআত পাঠ জটিল অনুভূত হলো। সালাত শেষে তিনি আমাদের দিকে ফিরে বলেন: আমি যখন সশব্দে কিরাআত পড়েছি তখন কি তোমরা কিরাআত পড়েছ? আমাদের কেউ বললেন, অবশ্যই আমরা পড়েছি। তিনি বলেন: এরূপ করো না। তাই আমি বলছিলাম, কি ব্যাপার! আমার সাথে কুরআন নিয়ে বিবাদ করা হচ্ছে! আমি যখন সশব্দে কিরাআত পাঠ করি তখন তোমরা কুরআনের কোন অংশ (কিরাআত) পড়বে না, তবে সূরা আল-ফাতিহা পড়বে।
(সুনানে আদ-দারাকুতনী, হা: ১১৯০, ই.ফা) ইমাম দারাকুতনী বলেন, এই হাদীসের সমস্ত রাবী নির্ভরযোগ্য। হাদীসটি ইমাম বুখারী তাঁর জুযউল ক্বিরাতেও নিয়ে এসেছেন। ইমাম বায়হাকী (আল-সুনান: ১৬৫/২) হাদীসটি সাদাকাহ বিন খালিদের সনদে বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী তার কিতাবুল কিরাআতে (পৃ:৬৪, হা: ১২১) বলেছেন, “এই সনদটি সহীহ, এবং এর বর্ণনাকারীগণ সিকাহ (নির্ভরযোগ্য)। এই হাদীসটিই প্রমাণ করে বুখারীতে উল্লেখিত উবাদা বিন সামিত রা: থেকে বর্ণিত ৭৫৬ নং হাদীসটি ইমাম, মুক্তাদী ও একাকী সালাত আদায়কারী সবার জন্য প্রযোজ্য।
৩. ইয়াহইয়া বিন ইউসুফ আল যামি+উবায়দুল্লাহ বিন আমর আল-রাকি+আইয়ুব বিন আবূ তামীমাহ+আবূ কিলাবাহ আবদুল্লাহ বিন যায়েদ আল-জারমি+আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল একবার সাহাবাদের সালাতে ইমামতি করছিলেন। সালাত শেষ করার পর তিনি সবার দিকে মুখ করে বললেন, “ইমাম যখন তিলাওয়াত করে তখন তোমরাও কি সালাতে তিলাওয়াত কর? তারা নীরব রইলেন। তখন আল্লাহর রাসূল (সা:) এ প্রশ্নটি তিনবার করলেন। তারপর একজন বললো: আমরা তিলাওয়াত করি।তখন আল্লাহর রাসূল (সা:) বললেন: এটা তোমরা করবে না, এবং তোমাদের প্রত্যেকে চুপে চুপে সূরাহ ফাতিহা পাঠ করো।
[সহীহ ইবনে হিব্বান (মাওয়ারিদ: ৪৫৮, ৪৫৯] আবূ ইয়ালা (আল-মুসনাদ: হা: ২৮০৫), বুখারী (জুযউল কিরাআত)] এ হাদীসের সনদ সহীহ। আলবানী, আহমাদ শাকীর, শোয়াইব আরনাউত্ব, ইবনে হিব্বান হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
৪. ইমাম বুখারী+আদনান (আবদুল্লাহ বিন উসমান)+ইয়াযিদ বিন জুয়ারী+খালীদ (আল-খাদায়া)+আবূ কিলাবা (আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ আল-যারমি)+ইবনু আবূ আয়িশাহ থেকে বর্ণিত, তিনি একজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন, যিনি রাসূল (সা:) এর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল (সা:) এক সালাতের ইমামতি করছিলেন, সালাত শেষ করার পর তিনি বললেন: ‘ইমামের ক্বিরাআত করার সময় সম্ভবত তোমরা পড়ে থাক? সাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই পড়ে থাকি। রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, এরূপ করবে না, তবে তোমরা প্রত্যেকেই সূরাহ ফাতিহা নীরবে পড়বে।
[বুখারী, জুযউল কিরআত, বায়হাক্বী (আল-সুনান, ১৬৬/২, কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ: ৭৫,৭৬ হা: ১৫৬), আহমদ হা: ১৮২৩৮, মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, হা: ২৭৬৬]ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, এর সনদ হাসান (আত-তালখীসুল হাবীর: ২৩১/১, হা: ৩৪৪) ইবনু খুযাইমাহ এ হাদীস থেকে দলীল গ্রহণ করেছেন, ইবনে হিব্বান একে মাহফুজ (সংরক্ষিত) বলে আখ্যা দিয়েছেন (আল-ইহসান: হা: ১৮৪৯)। শাইখ যবাইর আলী যাই রহ. বলেন এর সনদের প্রত্যেকটি রাবী সিকাহ। রাসূল সা: এর সকল সাহাবী নির্ভরযোগ্য, তাদের নাম যদি নাও জানা যায় তাতে কোন ক্ষতি নেই।
৫. ইমাম বুখারী+শুযায়ু ইবনে ওয়ালীদ+নাযার বিন মুহাম্মাদ আল ইয়ামানী+ইকরিমাহ বিন আম্মার+আমর বিন সা‘দ+আমর বিন শু‘আইব+শুআই বিন মুহাম্মাদ+আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা হতে দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল (সা:) বলেছেন: “তোমরা কি আমার পিছনে ক্বিরআত কর? জবাবে সাহাবীগণ বললেন: হ্যা! আমরা দ্রুত ক্বিরাআত করি। তিনি (সা:) বললেন: সূরাহ ফাতিহা ব্যতীত অন্য কোন কিছু পড়বে না।”
[বুখারী, জুযউল কিরাআত, বায়হাক্বী, কিতাবুল ক্বিরাআত, হা: ১৬৭] হাদিসের সনদ হাসান।
৬. উবাদাহ ইবনুস সামিত সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সা: এর পিছনে ফজরের সালাত আদায় করছিলাম। সলাত রসূলুল্লাহ সা: এর কিরাআত পড়াকালে ক্বিরাআত তাঁর জন্য ভারী হয়ে গেল। সলাত শেষে তিনি (সা:) বললেন, সম্ভবত: তোমরা তোমাদের ইমামের পিছনে ক্বিরাআত করেছে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসূল!হ্যাঁ। তখন তিনি (সা:) বললেন, এমনটি কর না, তবে তোমাদের সূরাহ ফাতিহা পড়াটা স্বতন্ত্র। কেননা যে ব্যক্তি সূরাহ ফাতিহা পাঠ করে না, তার সলাত হয় না। [আবূ দাউদ, হা: ৮৬৩, তিরমিযি হা: ৩১১]
আলবানী হাদীসটিকে দূর্বল বলেছেন। ইমাম তিরমিযি বলেছেন এর সনদ হাসান। হাফিজ ইবনে হাজার দিরায়া গ্রন্তে বলেন এর সমস্ত বর্ণনাকারী মজবুত। ইমাম হাকিম এর সনদকে মুস্তাকিম বলেছেন। শোয়েব আরনাউত এ হাদীসকে সহীহ লিগাইরিহি বলেছেন। আহমাদ শাকীর শাওয়াহিদসহ একে সহীহ বলেছেন।উপরের হাদীসগুলো থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো “যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না তার সালাত হয় না।” [বুখারী ৭৫৬] – এই হাদীসটি ইমাম, মুক্তাদী ও একাকী সালাত আদায়কারী সকলের জন্যই প্রযোজ্য। এ জন্যই সমস্ত মুহাদ্দিসগণের সর্দার ইমাম বুখারী রহ. এই হাদীস বর্ণনার পূর্বে অনুচ্ছেদ নির্ধারণ করেছেন: প্রত্যেক সালাতেই ইমাম ও মুক্তাদীর ক্বিরাআত (সূরাহ ফাতিহা) পড়া ওয়াজিব। মুক্বীম অবস্থায় হোক বা সফরে, সশব্দে ক্বিরাতের সালাত হোক বা নি:শব্দে। (দেখুন সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড, ১০/৯৫)
সাহাবীগণ সুরা ফাতিহা যেভাবে পড়তেনঃ সাহাবীগণ যেভাবে সূরা ফাতিহা পড়তেন তাতে কুরআনের কোন আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক হয় না। নিচের হাদীসগুলো দেখুনঃ
১. আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) বলেন: সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ সা: এর পিছনে ঐ সময় ক্বিরাআত করতেন যখন তিনি চুপ থাকতেন, পুণরায় যখন নবী সা: ক্বিরাআত পাঠ করতেন তখন সাহাবাগণ কিছুই ক্বিরাআত করতেন না। আবার যখন তিনি সা: চুপ থাকতেন তখন তাঁরা পাঠ করতেন। [বায়হাকীর কিতাবুল কিরাআত, পৃ: ৬৯; তিনি একে সহীহ বলেছেন]
২. আবূ হুরায়রা রা: বলেন: যখন ইমাম চুপ থাকেন তখন তোমরা ক্বিরাআত করা, আর যখন ইমাম ক্বিরাআত করে তখন তোমরা চুপ থাক। [বায়হাকীর কিতাবুল ক্বিরাআত, পৃ: ৬৬, সনদ হাসান] ইমাম যদি বিরতি না দেন তাহলে কিভাবে ক্বিরাআত করতে হবে তাও সাহাবী আবূ হুরায়রা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “যখন ইমাম সূরা ফাতিহা পড়ে তখন তোমরাও পড় এবং তার পূর্বে শেষ করো। [বুখারী, জুযউল কিরাআত, সনদ হাসান] এ আসারটি ঐ কথার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল যে, আবূ হুরায়রা রা: জেহরী সালাতে মুক্তাদীকে সূরা ফাতিহা পড়ার হুকুম দিতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী ফকীহ ইমাম মাকহুল ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে বলেছেন, “ইমাম জেহরী সালাতে যখন সূরা ফাতিহা পাঠ করে চুপ থাকেন তখন তোমরা চুপে পড়ে নাও। যদি চুপ না থাকেন তবে তার পূর্বে বা পড়ে পড়ে নাও। আর কোন অবস্থাতেই তা ছেড় না। [আবূ দাউদ ১/১৬০]
তবে এ বিষয়ে অনেকের অনেক রকম ইজতিহাদ রয়েছে, মত বিরোধ রয়েছে ।। তবে যে যে মতটিই গ্রহন করুক না কেনো, তাকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না।